পুষ্টির দিক থেকে মানবদেহের জন্য শাকসবজির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করার পাশাপাশি শাকসবজি দেহের রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই শরীরের চাহিদামতো শাকসবজি খেলে নানা রকম রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং শরীর সুস্থ থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, শাকসবজি খাওয়ার ফলে ক্যান্সার, কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম থাকে। গবেষকরা আরও জানিয়েছেন, যারা পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি খেয়ে থাকে তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আশঙ্কাও কমে যায়। শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে আঁশ থাকে। এই আঁশ খাদ্য দ্রব্য হজম, পরিপাক ও বিপাক প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। শাকসবজিতে বিদ্যমান আঁশ মলাশয়ের ক্যান্সার, বহুমূত্র, স্থূলকায়ত্ব, হৃদরোগ, রক্তচাপ, মূত্রনালির পাথর ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে দেহকে সুস্থ ও সতেজ রাখে। তাছাড়া শাকসবজি শিশুদের অপুষ্টিজনিত রাতকানা, অন্ধত্ব, রিকেট, বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগ, স্কার্ভি, মুখ ও ঠোঁটের কোণে ঘা, রক্তশূন্যতা দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, অপুষ্টি ও দেহের রোগ প্রতিরোধে শাকসবজির ভূমিকা অপরিসীম।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা বসবাস করে ৯৯৩ জন। যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এত বিপুল জনগোষ্ঠীর দানা জাতীয় খাদ্যের চাহিদা, শাকসবজি ফল এবং পুষ্টি চাহিদা পূরণ অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। আমাদের দেশে নানা প্রকার শাকসবজি উৎপন্ন হয় । এদের মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, টমেটো ও আলু, গাজর, বেগুন, মুলা, লাই, শিম, ধনেশাক, লালশাক প্রভৃতি অন্যতম। এসব শাকসবজিতে মানব দেহের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি এবং ক্যালসিয়াম, লৌহ, আয়োডিন প্রভৃতি অতি প্রয়োজনীয় খনিজ লবণ রয়েছে। তাছাড়া শাকসবজি থেকে কিছু পরিমাণে লৌহ পদার্থ এবং যথেষ্ট পরিমাণে শর্করা জাতীয় পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়।
শাকসবজি সংরক্ষণ করার একটি অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে প্রক্রিয়াকরণ এবং প্যাকেজিং। শাকসবজি পচনশীল তবে কিছু প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে এর সংরক্ষণ করা বা মেয়াদ বৃদ্ধি করা সম্ভব। কোন পণ্যের প্রক্রিয়াকরণ করা হলে সেই পণ্যের প্যাকেজিং করা অত্যাবশ্যকীয়। প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেজিং পণ্যের গুণগতমান বৃদ্ধি করে, সেলফলাইফ বৃদ্ধি করে ও মূল্য সংযোজন ঘটিয়ে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করে। শাকসবজির স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিমান বজায় রেখে তাজা সবজি ও ফলকে খোসা বা ছাল বা বাকল ছাড়িয়ে ব্যবহার উপযোগী টুকরা করে কোনো প্যাকেট বা মোড়কে সুসজ্জিত অবস্থায় ভোক্তার নিকট উপস্থাপনকেই বলা হয় ফ্রেশকাট।
ফ্রেশকাটের বৈশিষ্ট : পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত শাকসবজি ও ফলমূল, খোসা ছাড়ানো, কাটা ও বাছাইকৃত, সরাসরি রন্ধন ও খাওয়ার উপযোগী, আধুনিক মোড়কীকরণকৃত, নিশ্চিন্ত ব্যবহার।
ফ্রেশকাটের প্রয়োজনীয়তা : সময় সাশ্রয়ী, সহজে রন্ধনযোগ্য, সহজ সংরক্ষণ, অপচয় হ্রাস, পরিবেশবান্ধব।
ফ্রেশকাটের সুবিধা : সময় ও অর্থ সাশ্রয়ী, পুষ্টি ও গুণাগুণ অক্ষুণ্ন, রেডি-টু-কুক, বাছাইকৃত ও কাটাকুটির ঝামেলামুক্ত, সহজে বহনযোগ্য।
বাংলাদেশ বিশ্বের একটি জনবহুল দেশ। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের দেশ মধ্য আয়ের দেশে উন্নিত হওয়ার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। শাকসবজি উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩য় স্থানে। বাংলাদেশে বার্ষিক প্রায় ৪০ লক্ষ মেট্রিক টন শাকসবজি (আলু ব্যতীত) ও ৪৮ লক্ষ মেট্রিক টন ফলমূল উৎপাদিত হয় (বিবিএস)। বাংলাদেশে প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদিত হলেও প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কারণে বিপণন পর্যায়ে প্রচুর পরিমাণ শাকসবজি ও ফলমূল নষ্ট হচ্ছে, যা প্রায় শতকরা ২৫-৩০ ভাগ। এজন্য বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের অভ্যন্তরীণ ভোগ, ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা গ্রহণ করা আবশ্যক। এ প্রেক্ষিতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন কার্যক্রম সম্প্রসারণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে শাকসবজি ও ফলমূলের উৎপাদন পরবর্তী ক্ষতি কমিয়ে কৃষকদের আর্থিকভাবে লাভবান করা সম্ভব। অন্যদিকে কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখাও সম্ভব। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও শহরায়নের ফলে মানুষের বহুমুখী খাদ্যাভ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে উন্নত বিশ্বে প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূলের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও ব্যবসা হিসেবে প্রসার লাভ করেছে। আমাদের দেশেও বর্তমানে প্রক্রিয়াজাতকৃত ফ্রেশকাট শাকসবজির বাজার ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে শাকসবজির বর্তমান অবস্থা :
ফ্রেশকাট সবজি ও ফলের প্রেক্ষাপট :
পাশ্চাত্য এশিয়ার কিছু দেশে কিছু পূর্ব হতে এ ধরনের ফ্রেশকাট সবজি ও ফলের বাজার সম্প্রসারণ হলেও আমাদের দেশে এটি একটা নতুন ধারণা। তবে ক্রমশ পরিবতিত আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের পণ্যের প্রসার বর্তমান সময়ে কার্যকরী হতে পারে। কারণ ধীর গতিতে হলেও আমাদের নিম্নরূপ সামাজিক পরিবর্তন দৃশ্যমান-
একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি;
মধ্য আয়ের জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি;
খাবার তৈরির সময় কমে যাচ্ছে;
সহজ ভোগ্য খাবারের চাহিদা বৃদ্ধি;
রেস্তোরা ও ফাস্ট ফুড শপের কার্যক্রম ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে;
মানুষ ক্রমশ ফ্যাশন প্রবণ হয়ে ঊঠছে;
রপ্তানি বাজার :
ফ্রেশকাট শাকসবজির আন্তর্জাতিক বাজার ক্রমশ সম্প্রসারণশীল। থাইল্যান্ড বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক দেশ। রপ্তানির পরিমাণ বছরে প্রায় ২,০০০ টনের বেশি। সবচেয়ে বেশি ফ্রেশকাট ব্যবহার করা হয় আমেরিকায় যার যার আর্থিক মূল্যমান ৪.৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে ফ্রেশকাট সবজি ও ফলের রপ্তানি বাজার সীমিত আকারে হলেও শুরু হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে বেশ কয়েকটি কোম্পানি আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে ফ্রেশকাট সবজি রপ্তানি শুরু করেছে।
বাংলাদেশ থেকে ফ্রেশকাট রপ্তানি বাজারে প্রবেশ ও সম্প্রসারণের অনুকূল দিকসমূহ
ব্যবহৃত কীটনাশকের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ; অনুজীবের সংক্রামক নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ গ্রহণ; খাদ্যের আদর্শমান নির্ধারণ ও যথাযথ পরিদর্শন ল্যাব সুবিধার সৃষ্টি; আমদানিকারক দেশের খাদ্য আইনের সাথে সংগতি বিধান; ক্রেতার চাহিদা মাফিক মান বজায় রাখা; আন্তর্জাতিক সংস্থা যথা ডঐঙ, ঋঅঙ এর নির্দেশিতমানের সাথে সংগতি রাখা; বহির্বিশ্বের ন্যায় আমাদের দেশেও ‘রেডি টু কুক-রেডি টু ফুড’ প্রক্রিয়াটির প্রচলন বর্তমানে সময়ের দাবি। বর্তমানে রাজধানীসহ বড় বড় শহরসমূহে ব্যাপক হারে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি কর্মমুখী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগরায়ণ ও শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের ব্যস্ততা বাড়ছে। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের মানুষও ব্যাপক হারে আধুনিক বিপণন ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। পরিবারের কর্মব্যস্ত মানুষের পক্ষে প্রতিদিন বাজার থেকে কৃষি পণ্য ক্রয় ও বাজারজাত করে আহার উপযোগী করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাই সকলেই হাতের নাগালের মধ্যে সহজলভ্য ও প্রস্তুতকৃত পণ্য ক্রয়ে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। বর্তমানে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের আওতায় ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূল বিপণন সম্প্রসারণ কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের ৫টি জেলা যথা- ঢাকা, নরসিংদী, খুলনা, রংপুর ও কুমিল্লা জেলায় ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূল বিপণন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা মহনগরীর বিভিন্ন সুপারসপ, স্কুল-কলেজ ও কর্মব্যস্ত এলাকায় কর্মজীবীদের সুবিধার্থে কর্মসূচির আওতায় সৃষ্ট উদ্যোক্তা কর্তৃক কুল চেম্বার সমৃদ্ধ ভ্যানের মাধ্যমে ফ্রেশকাট শাকসবজি বিপণন করা হচ্ছে।য়
‘ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূল করলে ব্যবহার
কর্মজীবী মানুষের সুবিধা অপার’
তৌহিদ মোঃ রাশেদ খান
সহকারী পরিচালক ও কর্মসূচি পরিচালক ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন কার্যক্রম সম্প্রসারণ কর্মসূচি কৃষি বিপণন অধিদপ্তর খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৭৭০৫৫১২৩৭